ইসরায়েলের আগ্রাসনে লেবাননে লাশের স্তূপ

ইসরায়েলের আগ্রাসনে লেবাননে লাশের স্তূপ

লেবাননে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বর্বর হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে লাশের স্তূপ জমেছে দেশটিতে। গত দু’দিনের হামলায় লেবাননে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫৮। এর মধ্যে অন্তত ৫০ শিশু রয়েছে। আগ্রাসনে আহত হয়েছেন ১ হাজার ৮৩৫ জন। 

মঙ্গলবার লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব তথ্য জানিয়েছে। ১৯৯০ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে প্রাণঘাতী সময় পার করছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটাপন্ন মুসলিমপ্রধান দেশটি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলছে, লেবাননে ১ হাজার ৫০০ হামলায় ২ হাজার অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার জন্য তারা এ অভিযান চালাচ্ছে।


অন্যদিকে, লেবানন থেকে সোমবার রাতে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারাও ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালিয়েছেন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, সোমবার রাতে লেবানন থেকে আফুলা এলাকা ও উত্তর ইসরায়েলের উপত্যকাগুলো নিশানা করে ২০০টির বেশি রকেট ছোড়া হয়েছে। 


রাতভর এসব অঞ্চলে হামলার সতর্কতার ‘সাইরেন’ বেজেছে। হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত দুই ইসরায়েলি। দক্ষিণ ইসরায়েলের সাফেদ এলাকার একটি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে দুই দফা রকেট হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের একজন সামরিক মুখপাত্র সিএনএনকে জানিয়েছেন, বেশির ভাগ রকেটের টার্গেট ছিল উত্তর ইসরায়েলের লোয়ার গ্যালিলি ও হায়ামাকিম এলাকা। 


সামরিক বাহিনী আরও বলেছে, বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র বাধা দেওয়া হয়েছে। তবে হামলায় ভবনের ক্ষতি হয়েছে। মঙ্গলবার ইসরায়েলের ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ সার্ভিসের ক্রুদের প্রকাশিত ভিডিওতে হামলার কারণে সৃষ্ট আগুন নেভাতে কাজ করতে দেখা যায়। পাল্টা হামলার আশঙ্কায় গতকাল ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানায় টাইমস অব ইসরায়েল। 


লেবাননেও সব স্কুল বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়। হামলার কারণে দক্ষিণ লেবানন থেকে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে রাস্তায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন অব্যাহত থাকায় অন্য ফ্রন্টেও যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাল্টাপাল্টি হামলার জেরে বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ সংস্থা বৈরুতে উড়োজাহাজ চলাচল সাময়িক বন্ধ রেখেছে।


গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক বছর ধরে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে আন্তঃসীমান্ত লড়াই চলছে। এতে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বাস্তুচ্যুত হয়েছেন উভয় দেশের লাখ লাখ মানুষ। হিজবুল্লাহ বলেছে, তারা হামাসের সমর্থনে কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা তা থামাবে না। 


দুটি সংগঠনই ইরানসমর্থিত। ইউনিসেফ সতর্ক করে দিয়েছে, লেবাননে এখনও অনেক শিশু ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ রয়েছে। লেবাননের জন্য ইউনিসেফের ডেপুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইটি হিগিন্স মঙ্গলবার জাতিসংঘের ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেছেন। এদিকে, গতকাল বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলিতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় একজন হিজবুল্লাহ কমান্ডার নিহত হয়েছেন। ইব্রাহিম কুবাইসি নামে নেতা সংগঠনটির রকেট বিভাগের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন বলে দুটি নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে জানিয়েছে রয়টার্স। 


ওই হামলায় মোট ছয়জন নিহত হন। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে লেবাননে তাদের আগের সামরিক অভিযানের অভিজ্ঞা খুবই তিক্ত। বিভিন্ন সময় যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক ইসরায়েলি সেনা প্রাণ হারিয়েছেন দেশটিতে। দৃশ্যত এ কারণে গতকাল জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন বলেন, লেবাননে স্থল অভিযানের ইচ্ছা নেই তাদের।


‘পরিস্থিতি ভয়াবহ বিপজ্জনক’

 ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। হিজবুল্লাহর সঙ্গে তাদের চলমান সংঘাতে ইরানকে জড়াতে ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরু করতে ইসরায়েল উস্কানি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। 


এ ধরনের কিছু হলে তার ‘অপরিবর্তনীয়’ পরিণতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন তিনি। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে সোমবার নিউইয়র্কে উপস্থিত হয়ে একদল সাংবাদিককে এসব কথা বলেন তিনি। পেজেশকিয়ান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার কারণ হতে চাই না আমরা। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই, যুদ্ধ চাই না। তবে ইসরায়েল চায় সর্বাত্মক সংঘাত তৈরি করতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা নিরসনে কাজ করছে, যাতে করে লোকজন নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারেন। 


অন্যদিকে পেন্টাগন ঘোষণা করেছে, তারা ‘সতর্কতার অংশ হিসেবে’ সৈন্যদের অতিরিক্ত একটি ছোট দল মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন, তিনি চান না ‘লেবানন আরেকটি গাজায়’ পরিণত হোক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছেন, ‘পরিস্থিতি মারাত্মক বিপজ্জনক ও উদ্বেগজনক।’ নিউইয়র্কে বিশ্বনেতাদের সমবেত হওয়ার আগে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা প্রায় একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।’ 


লেবাননে ইসরায়েলের হামলা মধ্যপ্রাচ্যকে পুরোপুরি অস্থিতিশীল করে তোলা ও পুরো অঞ্চলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রাখে বলে সতর্ক করেছে ক্রেমলিন। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে লেবাননে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে প্রশ্নে রুশ সরকারের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ এ কথা বলেন। হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগার হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে কয়েক দশক ধরে সংঘাত চলছে। 


ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালালে তার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮২ সালে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি গঠিত হয়। সেই সময় ইসরায়েলি আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য বেশ কিছু লেবানিজ দল গঠিত হয়, যার একটি ছিল শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের হিজবুল্লাহ। আলজাজিরা বলছে, হিজবুল্লাহ ছিল মুসলিম নেতাদের মস্তিষ্কপ্রসূত। বর্তমানে হিজবুল্লাহকে বিশ্বের সবচেয়ে ভারী অস্ত্রধারী রাষ্ট্রবহির্ভূত সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 


তাদের অস্ত্রাগারে আনুমানিক ১ লাখ ৩০ হাজার রকেট রয়েছে। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা অধ্যয়ন ইনস্টিটিউটের হিসাবে, হিজবুল্লাহর কাছে ১৫-২০ কিলোমিটার পাল্লার ৪০ হাজার গ্র্যাড-টাইপ মিসাইল রয়েছে। পাশাপাশি সংগঠনটির কাছে ৮০ হাজার দূরপাল্লার মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম রয়েছে, যার পরিসর ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল)। 


এ ছাড়া তাদের কাছে প্রায় ৩০ হাজার জেলজাল আর্টিলারি রকেট বা ফাতেহ-১১০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার পাল্লা ২০০-৩০০ কিলোমিটার। হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডারের সবচেয়ে দীর্ঘপাল্লার এই অস্ত্র দক্ষিণ ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url